নামে কী যায় আসে?

হয়ত আসে। আমাকে দিদার বাড়ি – পাড়ায় সবাই টুপ্পা বলে ডাকে। ঠাকুমার দিকে সবাই ফুয়া। এক কথায় নূতনপল্লীতে টুপ্পা। ঢলদীঘিতে ফুয়া।

বিজয়াতে যেতাম ঠাকুমার বাড়ি। মিত্র ভবন। বাবা, মা, আমি, দাদা। নূতনপল্লী – কবরখানা – কালিবাজার -টাউনহল পাড়া হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঢলদীঘি।

টুপ্পা থেকে ফুয়া!

যেতাম আমরা লক্ষ্মীপুজোর ঠিক আগের দিন। বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। হিম পড়া সন্ধ্যা। আর ছাতিম ফুলের গন্ধ।

বিরহাটার প্রতিমা বিসর্জন হত আটটার একটু পরে। ঢলদীঘির টলটলে জলটা দুলে উঠতো প্রতিমার স্পর্শে। চাঁদের আলোয় রুপোলি কোঁচকানো জলে দুর্গার মুখ আসতে আসতে ডুবে যেত। কেমন যেন একটা লাগতো। হঠাৎ এক শূন্যতা। বুঝতে পারতাম কিছু চলে গেলে ফাঁকা হয় আশপাশ। ভেতরে। বাইরে।

লক্ষ্মীপুজোর দিন যেতাম দিদার বাড়ি। টুপ্পা হওয়ার দিন।

পুজো হত না। ‘প্রসাদ’ হত। বাতাবি লেবু – বাতাসা – নারকেল নাড়ু- তিলের নাড়ু। কাঁসার থালায় নানা রঙের সংমিশ্রণ। দিদা, কানন দি(রাঁধুনি)-কে নিয়ে গোটা দুপুর ধরে করতেন নাড়ু। সন্ধ্যা থেকে আসতে শুরু করতো আশেপাশের বাড়ি থেকে প্রসাদ।

কিছুক্ষন পরে আমরা সবাই উঠতাম ছাদে। তিনতলার ছাদ থেকে যেদিকে তাকাতাম শুধু চোখে পড়তো নারকেল গাছের সারি। মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে। সবুজ – রুপোলি আলোড়ন। চারদিক থেকে ভেসে আসতো ধূপ- ধুনোর গন্ধ।

আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে… দিদা বাবাকে গাইতে বলতেন।

হেমন্ত সন্ধ্যায় বসন্তের মাতাল সমীরণের গান? আবাহনের দিন হারাবার গান? বাবা মনে হল অরাজি।

গাও না? দিদা নাছোড়বান্দা।

বাবাকে এবার গাইতে হত।

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে/ যদি আমায় পড়ে তাহার মনে….

গানটা ছুটে চলতো এক দিগন্ত থেকে আর এক দিগন্তে। কেমন একটা হাহাকার।

হেমন্তে কোন বসন্তেরি বাণী পূর্ণশশী ওই- যে দিল আনি।

প্রথম গানের সমর্থনে হয়ত বাবার দ্বিতীয় গান।

আবেশ লাগে বনে শ্বেত করবীর অকাল জাগরণে।/ ডাকছে থাকি থাকি ঘুমহারা কোন নাম না জানা পাখি।/ কার মধুর স্মরণখানি পূর্ণ শশী ওই-যে দিল আনি।।

রাত হয়ে যেত। বাড়ি ফিরে আসতাম আমরা। সঙ্গে কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমোতাম না কেউ। চাঁদের সঙ্গে জেগে থাকতাম সারা রাত। বাগানের একগুচ্ছ স্থল- পদ্ম পাহারায়। যদিও পুজো হয়ে গেছে, তবু সাবধানের মার তো নেই!

কোজাগরী পূর্ণিমায় এখন অনেক কিছু জাগে। ঢলদীঘির জল, দিদার নারকেল নাড়ু, বাবার গলায় বেহাগ রাগের মাতাল সমীরণ, শ্বেত করবীর অকাল জাগরণ। আর বাগানের কোণে একগুচ্ছ স্থলপদ্ম।

ভোরের হালকা হিমে ঢেকে যাওয়া উল্লাস উপনগরীতে আজ সব কেমন জলছবি।

ফুয়া- টুপ্পা নামগুলো আজ ফিকে। বাড়ির রাখা নামেই পরিচিতরা ডাকে।

Leave a Reply