ঝুপা, সুতনু এসেছে…
ডাকটা পেতাম যখনই যেতাম বোরহাটে। মৌসুমীদির বাড়িতে। নিচ থেকে ওপরে উঠতে বাঁ দিকে তাকাতাম একতলার প্রথম ঘরটাতে।

ঘর ভর্তি রুগী। ডাক্তারবাবু, মৌসুমীদির শ্বশুরমশাই, একমনে রুগী দেখে চলেছেন। প্রশ্ন করছেন। উত্তর শুনছেন মন দিয়ে। প্রয়োজনে নোট নিচ্ছেন। তারপর পুরিয়া।

রুগী যদি গল্প জুড়ে দেয়, সোৎসাহে যোগ দিচ্ছেন।

শীত- গ্রীষ্ম- সকাল- দুপুর- সন্ধে-রাত — সবসময় রুগী দেখা চলছে। প্রায় বিরামহীন। মুখে একটা মৃদু কৌতুকের হাসি। যেন একটা মজা- যাপন।

আর এই মজায় মজে নিজের দিকে তাকালেনই না। শরীর ভাঙলো। পেসমেকার বসলো।

রুগী দেখা কিন্তু বন্ধ হল না।

বিজয়ের কাছে শুনেছি ফিজ দিতে গেলেই ভয়ানক রেগে যেতেন।

নিজের অসুখটা আগে সারাও হে। ফিজের আবার কী?!

প্রায়ই দেখতাম রামধুনির রিকশায় চেপে Curzon Gate – এর দিকে আসতেন।হোমিও হলে। ওষুধ কিনতে। হাতে লম্বা ফর্দ। প্রচুর ওষুধ কিনতে হবে যে।

আর ওই ওষুধ দেবার সময় জানলার বাইরে আমার দিকে চোখ পড়তেই, ঝুপা, সুতনু…..

খাওয়াদাওয়া সব অসময়।

সৃষ্টিকর্তা এত অনিয়ম সম্ভবত মানলেন না। তুলে নিলেন বিরানব্বই বছরের স্বভাবে তরুণ এই চিকিৎসককে।

শহর, গ্রাম-গঞ্জ, কাছে- দূরে সব জায়গা থেকে মানুষ ভিড় করেছিল তাঁর বাড়িতে সকাল থেকেই। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তারবাবু তাঁর আরাধ্য দেবতার ফটোর সামনে হাত জোড় করে কিছু বলতে বলতে চলে গেছেন জীবনের ওপারে।

আমি গেছিলাম রাতের দিকে। অর্ণবদা- মৌসুমীদি( ডাক্তার বাবুর আদরের ঝুপা)- লুনাদি- গৌতমদারা সব কাজ শেষ করে ফিরে আসার পর।

কাকিমা আসলেন। বসলেন খাটে। চাদরটা ঠিক করতে করতে বললেন বাষট্টি বছরের একসঙ্গে পথ চলার কথা। চোখটা গভীর। বিষণ্ণ। গভীরতা যেন বিষণ্ণতাকে একটু প্রশ্রয়ই দেয়।

সেই কাকিমাও চলে গেলেন, হুট্ করে।ডাক্তারবাবু যাওয়ার পাঁচ মাসের মাথায়।

আমি গেলাম রাতের দিকে। পরে একদিন।

অর্ণবদা, মৌসুমীদির মুখে একরাশ ক্লান্তি। কপালের বলিরেখা প্রকট। ফ্রান্সে ছেলের(বুবকা) কাছে গেছিল ওরা। খবর পেয়ে সাত তাড়াতাড়ি জার্মানিতে পুত্রবধূর কাছে যাওয়া স্থগিত রেখে ফিরে এসেছে। হতভম্ব। বিস্মিত।

এত তাড়া কিসের? এইতো আইফেল টাওয়ার থেকে ভিডিও কল করেছিল অর্ণবদা। লুনাদির বাড়িতে। মেয়ের বাড়িতে বসে কথা বলেছিলেন খুশি হয়ে পুত্র-বৌমার সঙ্গে। আর তার তিনঘন্টার মধ্যেই ফাঁকি!

ঘরে ঢুকে দেখি কাকিমা আমার দিকে চেয়ে আছেন। ফটো ফ্রেম থেকে। আলমারির পাশে। যার সামনে চেয়ার পেতে আগে অনেক গল্প করেছেন। মুখে কাকিমাসুলভ সেই স্নেহের হাসি। সামনে রজনীগন্ধার মালা।

বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। ফিরে আসলাম।

স্যার, পুত্রসন্তান হয়েছে!
ফোনের অন্যপ্রান্তে জয়দীপের বেশ উত্তেজিত কন্ঠস্বর।

বাঃ! দারুন খবর।
চন্দননগরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে বললাম। অষ্টমীর জগদ্ধাত্রী মণ্ডপের ভেতর থেকে চেয়ে আছেন। একটু আগে হয়ে যাওয়া প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তা প্রায় ফাঁকা।

নাম দীপ্তার্ক। বাবা রেখেছে।
বৃষ্টির পর সূর্যের উঁকিতে ঝলমলে প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে নাম টা শুনেই বললাম, দারুন নামটা!

আমার ভাইপো তার ভাইকে দেখতে এসেছিল! কাল দুপুরে জয়দীপ বললো।

সে আবার কত বড়?

দীপ্তার্কর থেকে ছ’মাসের!
জয়দীপ জোরে হেসে উঠে বললো।

করবীর দেওয়া চারাগাছগুলো বিকেলের দিকে টবে লাগাচ্ছিলাম। হেমন্তের বিকেল নিমেষে কেমন এক হালকা অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল।

পাশের বাড়িতে ‘চারুলতা’ দেখছে। সেতারে বাজছে একটু অলংকরনে ধীরে, মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে/ তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।

নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,/ তাতা থৈথৈ, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈথৈ….।

একটু নুয়ে পড়া চারাগাছগুলোয় ওপর থেকে আলগা জল ছেটালাম।

ওদের বেশ সতেজ লাগলো।

কচি পাতা থেকে কাদালাগা জল হাত দিয়ে সরিয়ে টবটাকে দরজার পাশে রাখলাম।

আগামীকালের সূর্যের আলোটা ওর চাই।

This Post Has One Comment

  1. Mousumi Mukherjee

    আমি তো এখন লিখতে পারি۔۔ না | বন্ধ্যা দশা চলছে۔۔

    তোর এই নির্ঝরের মতো۔۔ যাপিত অক্ষরমালায় খানিক স্নাত হলাম |

    মা বাবা ۔۔۔۔۔ আমার জীবনের দুই অবলম্বন ছিলেন |

    বাবা চলে যাবার পর শোক আত্মস্থ করে নিচ্ছিলাম সময়ের প্রতিঘাতে | কিন্তু আচমকা মায়ের পৃথিবী বাসের পালা শেষ হয়ে যাওয়ায় বিমূঢ় , কষ্টে কষ্টে আলোড়িত প্রতিদিনের যাপনে۔۔

Leave a Reply