জিতের সঙ্গে আমার পরিচয় কলেজে। ও একটু রোগাটে। লম্বা। চশমার পেছনে চোখটা খুব ব্রাইট। স্মোক করত খুব। বোঝা যেত নিজেতে খুব নেই।

জিৎ থাকত বড়শুলে। সরস্বতী পুজোতে একবার ডেকেছিল। জাগরনীর পুজো। মন্ডপ থেকে আলপনা– সব জিতের। আমাদের ক্লাবের অ্যাসেট। ক্লাবের কোন এক গন্যমান্য কেউ বলেছিল। জিতের মুখে এক চিলতে হাসি।

পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় জিৎ ফেল করল।অপ্রত্যাশিত! জিতের মুখে সেই এক চিলতে হাসি।

একদিন ট্রেনে করে আমার সঙ্গে যাবি? জিত বলল, ওকে যখন ড্রপ করলাম বর্ধমান স্টেশনে। কলেজের পর।

ঘাড় নাড়লাম। যাব। অবশ্যই যাব।

দু’দিন পর গেলাম। মেমারির আগে একটি স্টেশনে গাড়ি ঢুকতেই জিৎ বলল, বাড়িটা দেখ।

দেখলাম একটা মলিন লাল দোতলা বাড়ি। স্টেশন লাগোয়া। যেন একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে।

কী আছে এই বাড়িতে? একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

সব। আমার সব। জিৎ বলছিল। চশমাটায় যেন হালকা বাষ্প। পুঁছে নিল রুমালে।

পড়তে আসতাম এই বাড়িতে। অঙ্ক করতে। স্যারের বোন, অঙ্কিতা, আমাদের ব্যাচেই পড়ত।

যখনই ওর দিকে তাকাতাম, দেখতাম আমারই দিকে তাকিয়ে আছে।

এরপর কথা শুরু হল। সঙ্গে ভাব।

ঝুলন পূর্ণিমার দিন আমার হাতে রাখি পরিয়ে বললো, ভুল না। কোনদিন। কথা দাও।

কথাটা আর দেওয়া হল না। স্যার অঙ্কিতার মনোভাব বুঝেই সাত তাড়াতাড়ি বোনের বিয়ে দিয়ে দিলেন তাঁরই এক ইঞ্জিনিয়ার ছাত্রের সঙ্গে। বিদেশে।

আমি স্যারের কাছে যাওয়া বন্ধ করলাম। সঙ্গে পড়াশোনা। কোনোরকমে টুয়েলভ ক্লাস পাশ করে আজ কলেজে। পার্ট টু তে পার্ট ওয়ান এর শর্টফল পুষিয়ে দেব।

পুষিয়ে দিয়েছে কিনা আমার জানার উপায় ছিল না। কারণ কলেজ শেষ করে আমি ইউনিভার্সিটিতে। জিতের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষিণ থেকে ক্ষিণতর।

একদিন রামপুরহাটে ফিরছি। মেমারি থেকে। রসুলপুরে গাড়িটা স্লো হতেই কে এক গান ধরলো, তখন অন্য মন, অন্য আশা, অন্য ভাষা / জানিনা কী রূপ নেবে ভালোবাসা,/ তুমি যদি মনে মনে মগ্ন হয়ে / ফুলের শিশু হয়ে রও ঘুমিয়ে,/ আমি সূর্যের হয়ে তোমাকেই যাব ছুঁয়ে / সে কথাটি ফুল হয়ে যাবে।

চমকে তাকালাম। এই গান গেয়ে ভিক্ষে?

সাদা ফতুয়া – পাঞ্জাবিতে এক লম্বা মানুষ গান গেয়ে চলেছে এক কামরা থেকে আর এক কামরায়। সাদা দাড়িতে মুখ প্রায় ঢাকা। ভিক্ষেটা উপ- লক্ষ্য। গান গেয়ে চলাটা লক্ষ্য তার।

কে এই ভিখারী?

মনে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে গাংপুরে নাবলাম।

আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে…
অন্য কামরা থেকে ভেসে এল সেই পুরুষের কণ্ঠস্বর।

Leave a Reply