এই ইচ্ছেটা সব গায়ক – গায়িকার। তোমায় গান শোনাব। শুনছে কি কেউ?
এইতো রবীন্দ্রমাস গেল। চারিদিকে অনুষ্ঠান। যেমন হয়। একপক্ষ কাল ধরে। শিল্পীরা এলেন। গাইলেন। চলে গেলেন। শুনলো কি কেউ? বরং দেখলাম নতুন কিছু দেখে লোকে আমোদ পেল। গান শুনলো কি?
তিনটে অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে।
১. রবীন্দ্রভবনে সুবিনয় রায় গাইতে এলেন। প্রথম গানটি, ‘হৃদয় নন্দনবনে’। ‘নন্দন’ আর ‘নিকেতনে’র নোটগুলো নিখুঁত ভাবে গলায় লাগল। গান গাইতে বসেই। বেশ কিছুক্ষণ পরে একেবারে পেছন থেকে একজন শ্রোতা অনুরোধ করে বসলেন শিল্পী যাতে তিনতালের একটি গান করেন। সুবিনয়বাবু বললেন, গানের নাম করুন। তালের নয়। রবীন্দ্রসংগীতে এরকম হয় না। শ্রোতাকে একটু সময় দিয়ে শুরু করলেন, ‘রাখো রাখো রে জীবনে জীবনবল্লভে’। শ্রোতাটি ‘তিনতালের বন্দীশ’ হয়ত শুনলেন। বাকিরা অন্তরার ‘গন্ধ চন্দনে’র এক নিখুঁত দ্রুত স্বর- মালিকার স্বাদ উপভোগ করলেন। যা তান নয়। গলা কাঁপিয়ে কষ্টার্জিত আন্দোলন ও নয়। এ এক স্বরসমষ্টির সূক্ষ ব্যবহার। যা রবীন্দ্রসংগীতের গভীর চেতনাজাত রাগ সংগীতের রেওয়াজ ( practice) থেকে আসে।
২. একজন উঠতি মহিলা শিল্পী, যিনি এক বরেণ্য শিল্পীর ভাইঝি, (বেসুরো) গান করে উঠে যাবার পরই গাইতে বসেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়।সেই রবীন্দ্র ভবনে। ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিও কাছে’। গোটা হলে তখন ‘উত্তীয়’ সুরের মাদকতা। প্রায় দু ঘন্টা গেয়ে শেষ করলেন, ‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী’ গেয়ে। রাত দশটায় ভৈরবীর আলোর ছটা মনে কোন সন্দেহ তৈরী করলো না। এমনই রোমান্টিক কণ্ঠের ইন্দ্র জাল।
৩. শান্তিদেব ঘোষ – সুচিত্রা মিত্র – রমা মন্ডলের তিন প্রজন্মের গানে সুচিত্রা মিত্র তাঁর অনুষ্ঠান শেষ করলেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গি তে, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’র
আহ্বানে। গোটা সংস্কৃতি হল, বলা বাহুল্য, মন্ত্রমুগ্ধ।
এই কয়েক বছর আগে শ্রীকান্ত আচার্য কয়েকটি আধুনিক গান পরিবেশন করার ফাঁকে বললেন, বর্ধমান ঢোকার একটু আগে পালশিটে রাস্তার ধারে একটা- দুটো কাশের উপস্থিতি তাঁর নজর এড়ায় নি রাতের বেলাতেও। এরপর, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে’ গাইলেন। সবাই যে রবীন্দ্র সংগীতের শ্রোতা, তা নয়। বরং বেশীর ভাগই এসেছেন আধুনিক শুনতে। অমল ধবল স্পর্শ করলো কিন্তু গোটা হল কে। পরপর বেশ কয়েকটা রবীন্দ্রসংগীত গাইলেন শিল্পী। শেষ করলেন তাঁর প্রিয়, ‘আমার নয়ন তব নয়নের নিবিড় ছায়ায়’ দিয়ে।
ওপরের তিনটি ও পরে সংযোজিত অনুষ্ঠানে কোথাও দেখিনি রবীন্দ্র সংগীত গাইতে বসে কেউ হারমোনিয়াম বেলো করে গলা সেধে নিচ্ছেন প্রত্যেকটি গান গাওয়ার আগে। প্রথম তিনটি ক্ষেত্রে তানপুরা, এসরাজ, তবলা ছাড়া আর কোন যন্ত্রাণুষঙ্গ ও ছিল না।
রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাকেন্দ্রগুলো ‘চলো নিয়ম-মতে’ মার্কা এক ছাঁদে ফেলা গায়ক-গায়িকা তৈরি( template) করে যাচ্ছেন। এঁদের প্রত্যেকের গান- গায়কি সব এক।
একটু নতুন কিছু কি ভাবা যায় না?
Long- notes সমৃদ্ধ রবীন্দ্র সংগীত কী ভাবে গাওয়া যেতে পারে, তার ready- reference কি কিন্নর কন্ঠীর গাওয়া মদন মোহনজির সুরে ‘লাগ যা গলে’ হতে পারে না?
ইষৎ দ্রুত লয়ের গান কিভাবে scan করতে হয়, তা কি রোশনলাল নাগড়াথজির সুরে ( আবার সেই কিন্নর কণ্ঠে) ‘রহে না রহে হাম’ গানটি থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় না?
( কিন্নর কন্ঠী আবার রবীন্দ্র সংগীতের একক নিবেদন করবেন বলে দু বছর বসে রইলেন। যে আয়োজনের দরকার ছিল, তার সময় পাওয়া গেল না! Music Board কি জানত না? Music Board!)
একটু out- of- box চিন্তার প্রয়োজন। তা নাহলে স্বখাত সলিলে ডুবে মরা ছাড়া (যা হয়েই গেছে বলে খেদোক্তি করেছেন বুদ্ধদেব বসু স্নেহ- ধন্য এক প্রাক্তন অর্থনীতিবিদ) আর কোন গতি থাকবে না।
কি অপূর্ব। আহা।।।