‘বয়। বয়।’ যখনি যেতাম দিদা বলতো। লাল লম্বা সিমেন্টের সিটে হাত বুলিয়ে দিয়ে। নিজে বসার পর যদি দেখতো আমি তখনো দাঁড়িয়ে আছি,সস্নেহে আবার বলতো,’বয়। বয়।’ এবার আমি বসতাম। না বসে যে উপায় নেই! ‘বাণী কেমন? কী রান্না করছে? চান এখনো করে নি?’ মেয়ে সম্বন্ধে এসব প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাপর্বের পর আসতো আমাকে নিয়ে মূল প্রশ্ন। ‘পড়াশোনা কেমন চলছে? অঙ্ক কেমন করছিস…?’

ছোট থেকেই অংকে আমি বরাবর কাঁচা। লাভ – ক্ষতি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না।অঞ্জন দা অনেক চেষ্টা করতেন। আমার অংকে বেশিরভাগটাই ক্ষতি। লাভের ঘরে সামান্য কিছু পড়ে থাকতো। একবার রেজাল্ট আউটের পর পাড়ায় ডিক্লেয়ার করলাম,’এবার অংকে একশোয় একশো পেয়েছি।’ কেউ যে ঠিক জিজ্ঞেস করেছিল তা নয়। নিজে থেকেই বলে উঠেছিলাম। কারণ পাড়ায় বেশিরভাগ অংকে একশোয় একশো। আমি কেন থাকি তেতাল্লিশে। বাপ্পা চলে গেল সটান বাড়ি। বেরিয়ে পড়লো সত্য। একশো নয়। তেতাল্লিশ। বলছিলাম না, লাভের ঘর আমার বেশ ফাঁকা।

সন্ধ্যা হলে দিদা চলে যেতো দাদুকে খেতে দিতে। আমিও উঠে পড়তাম। সকালে দেখতাম ঈষৎ ঝুঁকে দিদা আগের রাতের থালা- বাসন নিয়ে চলতো পুকুর ঘাটে। মন দিয়ে সেগুলো মেজে দ্রুত পায়ে চলতো রান্নাঘরের দিকে। সকালের জল – খাবার তৈরী করতে হবে এবার। ‘কেমন লাগে দিদা এতো পরিশ্রম?’ জিজ্ঞেস করতাম মাঝে মাঝে। ‘বয়।পাকা পাকা কথা আর বলতে হবে না।’ লাল সিঁড়িতে বসে দিদার উত্তর। ডিব্বা থেকে একটা পান বার করে মুখে দিয়েই একরাশ হাসি। প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতাম এবার।

বাড়িতে বসন্তোৎসবে গাইতে বললেই দিদা গাইতো,’আমার সকল দুখের প্রদীপ…।’ বাবা বাজাতো হারমোনিয়াম। উৎসবে লাগতো একটু বিষন্নতার স্পর্শ। কেন জানি না দিদা এই গানটা একটু বেশি পছন্দ করতো।

হেমন্ত শেষের কোন এক সন্ধ্যায় দিদা চলেগেছিল। জানতে পেরেছিলাম কয়েকদিন পর। আটের দশকের একদম শেষে পৃথিবী এতো মোবাইল হয় নি। আর দিদা তখন ছিল বিহারে। পাটনায়। ছোট মামার কাছে।

আজ কয়েক দশকের হেমন্তের পর মনে পরলো দিদার প্রিয় গানকে। আমার সকল দুখের প্রদীপ…। আর দিদাকে। এক হারিয়ে যাওয়া জেনারেশনের অনুচ্চ কণ্ঠের অনুরোধকে, ‘বয়। বয়।’

Leave a Reply