দেওয়াল ক্যালেন্ডারটা নাবালাম।পাতাটা ওলটালাম। ডিসেম্বর। বরফ আর শীতের মোটা পোষাকের ছবি। ক্যালেন্ডারটা আবার টাঙাতে গিয়ে কিছুটা ঘেমেও গেলাম। ফ্যানটা চালালাম। বেশ আরাম লাগলো। একটু হাসিও পেল যেন । ছোটবেলায় ডিসেম্বরের এক তারিখ থেকে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু হত। পর পর চলে ছয় তারিখে শেষ হত। চব্বিশে ডিসেম্বর রেজাল্ট আউট। পুজোর পর থেকেই কেমন এক ভয় ভয় ভাব। পরীক্ষা সামনে। ভোর চারটে থেকে লেপের ওম ছেড়ে পড়তে বসা। একটা ফুল সোয়টার গায়ে চাপিয়ে। পরীক্ষা শেষের দিন স্কুল থেকে সোজা চলে যাওয়া তেঁতুলতলা বাজারে। ঘুড়ি- সুতো কেনা। বাড়িতে এসেই ছাদে। নীল আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো। পেছন থেকে উত্তুরে হাওয়া। গায়ে বড়ো এক মায়ের বুনে দেওয়া সোয়টার।

নভেম্বর মাসের গোড়ার দিক থেকেই ভুটানিরা আসতো রানীগঞ্জ বাজারের মোড়ে। রঘুদার ক্যাসেটের দোকানের উল্টো দিকে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। সন্ধ্যা বেলায় রঘুদার দোকান থেকে নিখিল ব্যানার্জীর সেতারে বেজে উঠতো রাগ হেমন্ত আর ভুটানি মেয়েদের হাতে ঝলমল করতো উজ্জ্বল রংবেরঙের উল। ওদের গালগুলো সব লাল। গা ধবধবে ফর্সা। দৈনন্দিকতার রানীগঞ্জ বাজার কেমন রঙিন হয়ে উঠত। মা ভুটানিদের কাছ থেকে উল কিনে দুপুরে পিঠে রোদ লাগিয়ে বাড়ির লম্বা বারান্দায় বসে উল বুনতো। তৈরী সোয়টার গায় চাপিয়ে কেমন ভিনদেশি স্পর্শ পেতাম।

শীতকাল আসতো আমার শহরে টাউন হলে বা তার বিপরীতে Municipal স্কুলের মাঠে বই মেলা নিয়ে। নতুন নতুন ষ্টল। নতুন নতুন বই। দুপুর থেকে রাত লোকজন। হাতে, কাঁধ – ব্যাগে বই।এক অন্য আড়ম্বর।

এখন শীতকাল ক্যালেন্ডার মিলিয়ে আসে ঠিকই। কিন্তু লেপ-সোয়টারে নয়। সিলিং ফ্যানের মৃদুমন্দ হাওয়ায় । ভুটানিরা আর আসে না। রঘুদার দোকান চুপ। ক্যাসেট- সিডির দিন শেষ। ঘুড়ি ওড়ে না। নীল আকাশ এখন পলিউশনের মেঘে ঢাকা। বই মেলার স্থান সগর্বে দখল করেছে ভিড়ে ঠাসা খাদ্য মেলা।

শিশির-স্নাত হেমন্ত বেপাত্তা। নিখিল ব্যানার্জীর হাত আজ স্তব্ধ। আর স্তব্ধ হাতে-হাত ধরে চলার শপথে চলা সম্পর্ক।

কেমন যেন আলাদা আলাদা সব।

This Post Has 2 Comments

  1. Sumana Sanyal

    নতুন বর্ধমানের নতুন দিনের শীতকালের এই ছবিটা কেমন যেন বিষণ্ণতার মেঘে ঢাকা। চাইলেও আর সেদিনের লেপের ওম, সেই অ্যানুয়াল পরীক্ষার ছোঁয়ালাগা শীত আর ফিরবেনা। সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় পড়ন্তবেলার এই শীতের স্মৃতিকাতর লেখা সত্যিই চমৎকার লাগলো

  2. Ananya Ghosh

    কি সুন্দর লিখেছ।ছবির মতো চোখের সামনে ফুটে উঠল সব কিছু!

Leave a Reply