আমাদের মধ্যে এমন একজন আছে যে brilliant। আগের দিনের task নিয়ে আমরা যখন হিমশিম খাচ্ছি, সে তখন রাতের এক ঘুম দিয়েই সাত সকালে ওই task টার সঙ্গে আরো নানান সুর জুড়ে নতুন নতুন structure তৈরী করে। ভাবা যায় না। কি সাংঘাতিক! শুভ্রা দি বলছিলো একদিন ক্লাসে। শুভ্রা গুহ আই. টি. সি. সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমির তখন ছাত্রী। পরে বড়ো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী হয়।মাঝে মাঝে আসতো কালীবাজারে Academy of Music – এ। ক্লাস নিতে। জোশিজি যখন থাকতেন না। ওই “একজন” শুভ্রাদির বন্ধু এস. আর. এর ছাত্র রাশিদ খান। আটের দশকের মাঝামাঝি সেই প্রথম এই নামটির সঙ্গে পরিচয়।

রাশিদ ভীষণ হুল্লোড়ে। আমার সঙ্গে সাইকেলে চেপে ও অনেকবার দামোদরের চরে গেছে। টাউন হলেও যেতাম। বাইরের পার্কে সিটগুলোতে বসতাম।খুব আড্ডাবাজ। কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ চুপ হয়ে যেতো। আমি বুঝতাম ও কোন সুর বুনছে। চুপ করে যেতাম তখন। শুভেন্দু দা বলছিলো একদিন। ওদের ভাতছালার বাড়িতে রাশিদ আসতেন। রাশিদ নামটার সঙ্গে আরো একটু পরিচিত হলাম।

সাতানব্বইয়ের গোড়ায়, জানুয়ারি মাসে এক পড়ন্ত বিকেলে রাশিদ ভীমপলাশী গাইছিলেন মিউনিসিপাল স্কুলের মাঠে। ছাত্র- যুব উৎসবে। ম্লান হয়ে আসা রোদের আলোয় রাগটি শুনতে শুনতে বারে বারে কেমন উদাস হয়ে যাচ্ছিলাম আকাশের এক কোণে উড়তে থাকা এক সাদা ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে। কোথাও আর কোন ঘুড়ি নেই। বিকেল যে শেষ হয়ে এলো। এরপর তো সন্ধ্যা। রাশিদ খানের গলায় ফিকে হয়ে আসা দিনের আলোয় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো এক প্রশান্ত আনন্দ। সঙ্গে ঈষৎ বিষন্নতা। সেদিন বুঝেছিলাম আনন্দের মাঝেই বিষন্নতার বাস। রাশিদ বুঝিয়েছিলেন তাঁর গায়কীতে।

অনেকদিন পর জগজিৎ সিং- এর স্মরণ সভায় রাশিদ খানের গান শুনলাম। দেশের অন্য গায়ক-গায়ীকাদের মধ্যে স্বতন্ত্র এক শিল্পী। সবাই সম্ভ্রম- জাগা মুখে শুনছেন। চিত্রা সিং-এর দিকে ক্যামেরা focus ফেলছিল। চিত্রা সিং- এর চোখের কোণে জল টলটল করছে। যাঁর টানে স্বামীকে ছেড়ে এসে বাঁধলেন ঘর। সেই মানুষটিই আজ আর নেই। দুনিয়া যিসে কহতে হ্যায়, যাদু কা খিলোনা হ্যায়…আর জগজিতের সঙ্গে গাইতে পারবেন না। কাঁদবারই কথা। রাশিদ আবেগ ঢেলে গাইছেন, ইয়াদ পিয়া কি আয়ে। হরিহরণ, অনুপ জালোটা, সনু নিগম, উদিত নারায়ণদের চোখে বিস্ময়। সব কড়ি- কোমল রাশিদের মায়াবী কণ্ঠের কাছে বন্দি।

সেই জানুয়ারির পড়ন্ত বিকেলে রাশিদ চলে গেলেন। সাদা চাদরে ঢেকে তাঁর নিথর দেহ বেড়িয়ে আসলো হসপিটাল থেকে। কাঁচ দিয়ে ঘেরা অ্যাম্বুলেন্স-এ।

কাল সন্ধ্যায় ছাদে উঠে দেখি কোনখান থেকে একটা ঘুড়ি কেটে পড়ে রয়েছে ছাদের এক কোণে। ঘুড়িটার রংটা সন্ধ্যার অন্ধকারেও বেশ উজ্জ্বল। সাদা ঘুড়িটা একটু ছেঁড়া, সন্ধ্যার শিশির-স্নাত হয়ে। ঘুড়িটা চিটিয়ে আমি উড়োবো। সামনের সোমবার। ঘুড়ির মেলায়। ওই একলা সাদা ঘুড়িটা আমায় মনে করাবে সাতানব্বইয়ের জানুয়ারির সেই অবিস্মরণীয় ভীমপলাশীকে।

সময় এগোয়। ফেলে রেখে যায় তার পথের রেখা। আর এই রেখাতেই লেখা হয়ে থাকে ইয়াদ পিয়া কি আয়ে। আর অমর হয়ে থাকেন রাশিদ খান।

Leave a Reply