নতুনপল্লি ছিল আমাদের পুরোনো পাড়া। বাড়ির নম্বর ২০। ২০,নতুনপল্লি — এই ঠিকানায় চিঠিপত্র আসতো আমাদের। আর আসতো ম্যাগাজিন। বড়ো চওড়া এনভেলপ-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর ছোট এনভেলপ-এ রিডার্স ডাইজেস্ট। বেশ লাগতো আমার। সকাল বেলা টাউন স্কুল থেকে ফিরতাম যখন, খাকি ফুল হাতা জামা-প্যান্ট পরা পিয়ন মামা হাসি হাসি মুখে বাড়ির সামনে সাইকেল থেকে নেমে বলতো, বাবু মা কে ডেকে দাও। আমি মাথা নাড়তাম। পিয়ন মামা একটু নিচু হয়ে হ্যান্ডেল থেকে মোটা হয়ে ঝোলা একটা থলি থেকে দুটো এনভেলপ হাতে দিয়ে দিতো। এবার হতো কাজ। আমি এক ছুটে হাজির রান্না ঘরে। মা, পিয়ন মামা। বাগান- গেটটা খুলে সদর রাস্তায় এসে মা সই করতো একটা বড়ো খাতায়। আমি আর সময় নষ্ট করতাম না। এনভেলপ ছিঁড়ে বার করতাম ম্যাগাজিনগুলোকে। চকচকে পাতায় চকচকে ছবি। বড়ো বড়ো বাড়ি। গাড়ি। আর নতুন নতুন মানুষ। খুব সুন্দর দেখতে। সঙ্গে নতুন পাতার নতুন গন্ধ। ওই নতুন কিছুর সঙ্গে থেকে মনটা কেমন নতুন হয়ে যেতো। সারাদিন অন্যরকম কাটতো।

সন্ধ্যা বেলা বাবা প্রায়ই রেকর্ড প্লেয়ারে গান চালিয়ে সামনের রাস্তায় পায়চারি করতো। একটা গান বেশ বলিষ্ঠ মহিলা গলায় বাজতো। তবু মনে রেখো। রেকর্ড কভারটা হাতে নিয়ে দেখতাম পাশ থেকে ছবি নেওয়া এক মহিলার মুখ। চশমা পড়া। গভীর। কপালে ভাঁজ। সুচিত্রা মিত্র।

আমাদের নতুন বাড়ি গীতবিতানে ওপরের ঘরে সেদিন দেখলাম রেকর্ড প্লেয়ারটা পরে আছে অন্য অগোছালো টুকিটাকি প্রায় ফেলে দেওয়া জিনিসপত্রের সঙ্গে। পিন পাওয়া যায় না। তাই ওটা বাজেও না। পাশেই পুরোনো বইয়ের ৱ্যাক থেকে পেলাম প্রাইমারি ক্লাসের ইংরেজি বই পারিজাত রিডার্সের মলাটে আটকে থাকা সোভিয়েত উনিয়নের একটা পাতা। পুরোনো। জীর্ণ।

আমার লাইব্রেরি রুমে যেখানে বসি ঠিক তার সামনের লেখার টেবিলে ফটো -ফ্রেমে বন্দি সুচিত্রা মিত্র। মুখে ঈষৎ হাসি। হাতে তানপুরা। Love-knot এ বলরামের কাছ থেকে বাঁধিয়ে এনেছি বেশ কয়েক মাস হোলো।

কাল রাতে নতুনপল্লি হয়ে ফিরলাম। কুড়মুন থেকে ফেরার পথে। দেখলাম পুরোনো বাড়িটা বসে গেছে।পাড়ার অন্যান্য বাড়িগুলোর মতো।সামনের রাস্তাটা উঁচু হয়ে গেছে অনেক। ফ্যাকাসে চাঁদে সবকিছু বড্ড অস্পষ্ট লাগছিলো। স্কুটারের হেডলাইটে দেখলাম বাড়ির নম্বরটাও গেছে বদলে।

একতলা ওই বাড়ির সামনে দিয়ে আসতে গিয়ে ভাবছিলাম ছোটবেলায় এই বাড়িতেই বাজতো গান। রেকর্ড প্লেয়ারে। তবু মনে রেখো।

This Post Has 2 Comments

  1. Manika Thakur

    কি সুন্দর লিখেছ, আমাদের ও কত স্মৃতি ওই বাড়িটিকে ঘিরে তোমরা স্যার কাকিমা আর আমাদের গান শেখা স্যারের সামনে ওই সামনের ঘরটিতে, মনের কোথায় যেন একটু মোচড় দিয়ে গেল..

Leave a Reply to Balaram Cancel reply